হাওজা নিউজ বাংলা রিপোর্ট অনুযায়ী, স্বভাব অনুযায়ী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদের ভেতরে-বাইরে দ্রব্যমূল্য নিয়ে মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছেন। ফ্যাসিস্ট সরকারের লুটেরা শ্রেণী ছাড়া বাংলাদেশের মানুষ যখন দিশেহারা, শেখ হাসিনা তখন জনগনের দুর্দশা নিয়ে তামাশা করছেন।
একদিকে মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে ভুয়া দাবি করছেন, অন্যদিকে কোটি কোটি টাকা খরচ করে ভারত থেকে গায়ক-গায়িকা এনে ফুর্তি করছেন।
জীবন-যাত্রার ব্যয় ও দ্রব্যমূল্য নিয়ে পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বর্তমানে ঢাকায় দ্রব্যমূল্য ও জীবন ধারনের ব্যয় ভারতের দিল্লি ও তুরস্কের ইস্তানবুলের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এককেজি আলুর বর্তমান বাজার দর ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। আর তুরস্কের ইস্তানবুলে এককেজি আলুর দর বাংলাদেশী মুদ্রায় ২৫ থেকে ২৬ টাকা। রমজানের প্রথম দিন ইস্তানবুলে এককেজি টমেটো বিক্রি হয়েছে বাংলাদেশী মুদ্রায় ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা দরে। আর রোববার প্রথম রোজার দিন ঢাকায় এককেজি টমেটোর মূল্য ছিল ৮৮ থেকে ৯৫ টাকা।
সরকারি সংস্থ্যা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) রোববার বাজার দরের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে এককেজি পেঁয়াজের মূল্য দেখানো হয়েছে ৪০ টাকা। তবে ঢাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে রোজার প্রথম দিন রোববার পেঁয়াজের মূল্য ছিল গড়ে ৪৫ থেকে ৫৫ টাকা। যা ইস্তানবুলে রোজার প্রথম দিন বিক্রি হয়েছে ২৪ থেকে ২৬ টাকা (বাংলাদেশী মুদ্রা) দরে। এক ডজন ডিমের মূল্য ঢাকায় ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা। ইস্তানবুলে এক ডজন ডিম পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশী মুদ্রায় ১০৮ থেকে ১১২ টাকায়।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিল্লির তুলনায় ঢাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে দিল্লির স্থানীয় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ঢাকার তুলনায় ৫৮ শতাংশ বেশি। ২ এপ্রিল এর তথ্য অনুযায়ি দিল্লিতে এক লিটার দুধের মূল্য বাংলাদেশী মুদ্রায় ছিল ৬২ থেকে ৬৪ টাকা। যা ঢাকায় বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা দরে। এককেজি আপেল দিল্লিতে পাওয়া যায় ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়। যা ঢাকার মানুষ কিনে খান ২০০ থেকে ২২৫ টাকা কেজি দরে।
প্রতিবেশি আরেক দেশ নেপালের কাঠমান্ডুর তুলনায়ও ঢাকায় নিত্যপণ্যের দাম ১৯ থেকে ২৯ শতাংশ বেশি (২এপ্রিলের তথ্য)। কাঠমান্ডুতে এককেজি ফার্মের মুরগী (চামড়া ছড়ানো বা প্যাকেটজাত) বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশী মুদ্রায় ২৬৫ থেকে ২৭০ টাকা দরে। যা ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা দরে।
তুরস্কের ইস্তানবুলে এক লিটার ভোজ্য তেল (সূর্যমুখী) বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশী মুদ্রায় ৯৮ টাকা দরে। ঢাকায় সূর্যমুখী তেল সাধারণ মানুষ কেনেন না। অভিজাত শ্রেণীর মানুষই এই তেলের প্রধান ক্রেতা। এই তেল লিটার প্রতি এখন ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর সাধারণ মানুষ ব্যবহার করেন সয়াবিন তেল।
রোজার প্রথম দিন রোববার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ৫ লিটারের এক বোতল সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ৭৭৫ থেকে ৭৮৫ টাকায়। কেউ ৫ লিটারের বোতল কিনতে গিয়ে পেয়েছেন এক/দুই লিটারের বোতল। বড় বাজারগুলোতে জরিমানার ভয়ে দোকানের তাকে তেল সাজিয়ে রাখলেও এলাকার মুদি দোকানগুলোতে তেলের সরবরাহ নেই বললেই চলে। ক্রেতাদের অভিযোগ, সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে। আর দোকানিরা বলছেন, স্টক যা ছিল শেষ হয়ে গেছে। তাদের কাছে আর তেলের মজুত নেই। দক্ষিণ খিলগাঁও এলাকার মুদি দোকানি রফিক মিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডিলাররা চাহিদা অনুযায়ী সয়াবিন তেল সরবরাহ করছে না। যা দিচ্ছে তাও বেশি মূল্যে। তাই তাদের পক্ষে খুচরা ক্রেতাদের চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না।
রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি বর্তমান সরকারের আমলে দেশে নতুন কিছু নয়। তবে এবারের ভোজ্যতেলের বাজার যেন ছাড়িয়ে গেছে অতীতের সব রেকর্ড। প্রথমে সংকট শুরু হয়েছিল তেলের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি দিয়ে। এখন বেশি দামেও পাচ্ছেন না ক্রেতারা। এযেন বোতলজাত তরল সোনা! হাতে পেলেই ধন্য হচ্ছেন ক্রেতারা।
গতকাল রাজধানীর কমলাপুর এলাকার বাসিন্দা তবারক হোসেন ৫ লিটারের সয়াবিন তেল কিনতে এজিবি কলোনি বাজারে গিয়ে ২ লিটারের তেল কিনে ফিরে আসেন। এদিকে রোজার বাজার করতে খিলগাঁও বাজারে এসেছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমদাদ হোসেন। কিন্তু সরকার নির্ধারিত দামে তেল কিনতে না পেরে কিছুটা বিরক্ত হয়েই তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ইফতারের ভাজাভাজি করতে গেলে বাড়তি তেল দরকার। তীর ব্র্যান্ডের ৫ লিটারের একটি সয়াবিন তেলের বোতল নিলাম ৭৭৫ টাকায়। যা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ১৫ টাকা বেশি।
তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশে পণ্যের পর্যাপ্ত পণ্য মজুত আছে। বাজারে গেলেও তাই মনে হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে- দাম বেশি। সব পণ্যের দামই আগের তুলনায় বেড়েছে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আগে দেখতাম রমজান এলে দাম বাড়ত। এখন ব্যবসায়ীদের কৌশল পাল্টেছে। দুই বছর ধরে দেখছি রমজান আসার এক-দুই মাস আগেই প্রায় থেকে ৪ গুণ দাম বাড়ায়। পরে একটু কমিয়ে বলে দাম কমেছে। কিন্তু আগের দামে আর ফিরে আসে না।
শনিবার রাজধানীর কয়েকটি বাজারে সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রতি লিটারে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন তেল। ব্র্যান্ড ভেদে এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ থেকে ১৮৫ টাকায়। আর পাঁচ লিটার বিক্রি হচ্ছে ৭৭০ থেকে ৭৯০ টাকায়। আর খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৭০ থেকে ১৭৮ টাকা; খোলা পামওয়েল ১৫৬ থেকে ১৬০ টাকা। অথচ লাগামহীন ভোজ্যতেলের দাম নিয়ন্ত্রণে গত মাসে কাঁচামাল আমদানি পর্যায়ে মাত্র ৫ শতাংশ বহাল রেখে ভোজ্যতেলের আমদানি, পরিশোধন ও ভোক্তাপর্যায়ে বিক্রিতে থাকা সব ধরণের ভ্যাট তুলে নিয়েছে সরকার।
এতদিন ভোজ্যতেলের ওপর তিন স্তরে ৩৫ শতাংশ ভ্যাট ধার্য ছিল। পরে গত ২০ মার্চ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে লিটারে সয়াবিন তেলের দাম ৮ টাকা কমিয়ে নতুন দামের ঘোষণা করে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স এন্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন। ওই ঘোষণা অনুযায়ী, খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৩৬ টাকা, বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬০ টাকা এবং পাঁচ লিটারের এক বোতল তেল ৭৬০ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা।
সরকার ভ্যাট কমানোর পরও এবারের রোজায় গতবারের চেয়ে বেশি দামেই ভোজ্যতেল কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত বছর এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১৩০-১৪০ টাকা। এবার ভ্যাট কমানোর পরও এখন তা কিনতে হচ্ছে ১৫৮-১৬৫ টাকায়। অর্থাৎ গতবারের তুলনায় দাম এখনো প্রায় ২০ শতাংশ বেশি।
নাম্বিউ (ঘটগইঊঙ) নামক আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা সারা বিশ্বের বিভিন্ন শহর ও উপশহরের ডাটা সংগ্রহ করে জীবন যাত্রার ব্যয়, মান ও মানুষের আয়-ইনকাম নিয়ে নিয়মিত তথ্য প্রকাশ করে থাকে। তাদের দেয়া সর্বশেষ ২ এপ্রিলের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের উন্নয়নশীল অনেক দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরের চেয়ে জীবন যাত্রার ব্যয়ে অনেক এগিয়ে।
যেমন ধরা যাক ইস্তানবুলের কথা। ঢাকার তুলনায় ইস্তানবুলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ১৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ কম। অন্যদিকে ইস্তানবুলে স্থানীয় ক্রয়ক্ষমতা ঢাকার তুলনায় ৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি।
সাধারণ মানুষ কী বলছে?
দ্রব্যমূল্য নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে এক ধরণের হতাশা। বাজার তালিকা থেকে অনেক পণ্য কেনাই বাদ দিচ্ছেন তারা। নুন আনতে পান্তহা ফুরায়-প্রবাদটি আজ চরম সত্য হয়ে ঘাড়ে বসেছে।
কথা হয় রাজধানীর বেসরকারি একটি স্কুলের শিক্ষক দেলোয়ার হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের চড়া মূল্যের বিরূপ প্রভাব পড়েছে অতিদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। আলু ছাড়া সব পণ্যের দাম বেশি। যে কারণে নিম্ন আয়ের লোকজন আলু খাচ্ছেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির যাঁতাকলে অসহায় মানুষের দুঃখের কথা বলার কোনো জায়গাও নেই।
বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। চাল, ডাল, তেল, গ্যাস, আটা, চিনি, মাছ, ডিম থেকে শুরু করে শাক-সবজি এমন কোনো নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেই, যার দাম বাড়েনি বা বাড়ছে না। বাজারজুড়ে মিলছে শীতের সবজি। কিন্তু ভরা মৌসুমেও তার দাম আকাশ ছোঁয়া। সিম, মিষ্টি আলু ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। যা গত বছর এই সময় ছিল ২০-২৫ টাকা কেজি। চালের দামও ভরা মৌসুমে ঊর্ধ্বমুখী। সাধারণ মানুষের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসেব মিলছে না।
নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ হতাশ হয়ে পড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে ক্ষোভ। হতাশায় নিমজ্জিত খেটে খাওয়া মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও।
নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধি গরীব, নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষসহ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনকে রীতিমত দুর্বিসহ করে তুলছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারেও আজ নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর দশা।
মুহাম্মদ মুনীর হুসাইন খান